করোনাভাইরাসে অনেক দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি ও মৃত্যুর প্রবণতার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি পার্থক্য চোখে পড়ছে। ঘনবসতি, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা এবং সাধারণ মানুষের পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
চীনের উহানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ডিসেম্বরের শেষে। জানুয়ারির শেষের দিকে চীনের সব প্রদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, চীনে ৮২ হাজারের বেশি রোগীই ছিল তখন সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু দ্রুতই চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করে। চীনের পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষজন বেশ আক্রান্ত হতে থাকে।
ইউরোপে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত দেশগুলোর একটি ইতালি। জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে জানুয়ারির শেষে ইতালিতে সংক্রমণ শুরুর পর ৫৯ দিনে এখনো পর্যন্ত সব মিলিয়ে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭ দিনে দেড় লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলো যেমন স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য প্রায় সবগুলো দেশেই ভাইরাসটি বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিই দেখা গেছে।
বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ইতালিফেরত। কিন্তু সেই ইতালি থেকে আসা ভাইরাস বাংলাদেশে কী ভিন্ন আচরণ করছে? এর সম্ভাব্য কী ধরনের কারণ থাকতে পারে?
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ডাটা অন্যদের সঙ্গে মেলে না কেন তা নিয়ে আমিও চিন্তা করছি। আমাদের এখানে ভাইরাসটি ইতালি থেকে এসেছে। সেটি ইতালিতে হ্যাভক তৈরি করল আর আমাদের এখানে কিছুই করছে না এরকম একটা ব্যাপার। বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, তবে উহান থেকে যে ভাইরাসটির উৎপত্তি তা কিন্তু মিউটেশন হয়েছে। কিছু দেশে একই ধরনের সংক্রমণের প্যাটার্ন হয়েছে। আবার অন্য কোথাও একটু ভিন্ন। আমাদের ভাইরাসটি উহান থেকে আসেনি। দেখুন, জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে অনেক দেশে, কিন্তু একটা দেশেই, মাইক্রোকেফালি দেখা দিল- সেটা ব্রাজিলে।
নজরুল ইসলাম বলেন, তারপর একটা ভাইরাস মালয়েশিয়ায় তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে নিপা ভাইরাস। যা বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের দিকে এলো এবং বাংলাদেশেই ঘোরাফেরা করছে। ভাইরাসের চরিত্র যথেষ্ট গবেষণা না করে বলা কঠিন।
তিনি আরো বলেন শুধু ভাইরাস নয়, যিনি ভাইরাসটি বহন করছেন তার কথাও বিবেচনা করতে হবে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটা ভাইরাস আছে সেটা আফ্রিকানদের যখন আক্রান্ত করে তখন তাদের এক ধরনের ক্যান্সার হয়, একটা লিম্ফোমা হয়। আর সেই ভাইরাসটিই যখন চীনাদের ইনফেক্ট করে- তখন তাদের নেজো-ফেরেঞ্জিয়াল কার্সিনোমা হয়। যারা ইনফেকটেড হয় তাদের জীনগত বিষয়টাও দেখতে হবে। একটা দেশের মানুষজনের জীনগত বৈশিষ্ট্যের ওপরও অনেক সময় রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক থাকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম যে রোগী শনাক্ত হলো ৮ মার্চ, এরপর প্রথম ইনকিউবেশন পিরিয়ড (লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কাল) ১৪ দিন। দুটি ইনকিউবেশন পিরিয়ড শেষ হবে এপ্রিলের পাঁচ তারিখ। এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। পাঁচ তারিখের পর সম্ভবত আমরা বলতে পারব যে বাংলাদেশে প্যাটার্নটা এ রকম।
ভারতে এ ভাইরাসের চরিত্র বদল বিষয়ে হায়দরাবাদে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজির (এআইজি) চেয়ারম্যান ও পদ্মভূষণপ্রাপ্ত জি পি নাগেশ্বর রেড্ডি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ ভাইরাস যখন ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে ছড়িয়েছে, তখন এর জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়েছে। এর জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা হয়েছে চারটি দেশে, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, পরে ইতালি, এরপর চীন এবং চতুর্থত ভারতে। সেখানে দেখা গেছে, ভারতে এ ভাইরাসের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য তৈরি রয়েছে ধরা যাক ইতালির তুলনায়। এর অনেক গুরুত্ব থাকতে পারে। কারণ ভারতে ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে কিছু জিনগত পরিবর্তন ঘটেছছে। স্পাইক প্রোটিন হলো সেই অংশ যার মাধ্যমে এটি মানব কোষে সংযুক্ত হয়েছে। একটি ছোট মিউটেশন ঘটে যাওয়ার ফলে মানবশরীরে এই সংযুক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে আমরা ভারতীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
তিনি বলেন, অন্য দিকে ইতালীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে তিনটি মিউটেশন ঘটতে দেখা গেছে, যা ভাইরাসটিকে আরো মারাত্মক করে তুলেছে। ইতালিতে অন্য কিছু বিষয়ও কাজ করেছে। সেগুলো হলো সেখানে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষের বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর, ধূমপান, মদ্যপানের পাশাপাশি ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ আছে যারা অন্য রোগকে তরান্বিত করে। এসব কারণে সেখানে মৃত্যুর হার বেশি যা প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে এ হার ২ শতাংশ। ভাইরাসের জীনের ওপর ভিত্তি করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার নির্ধারিত হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় আক্রান্তের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর।
এ বিশেষজ্ঞ ভারতে করোনাভাইরাস অন্য দেশের তুলনায় কম ক্ষতিকর হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘না, আমরা এটা সরাসরি বলতে পারি না, তবে যা বলতে পারি, এ ভাইরাসের জীনগত ভিন্নতা অবশ্যই ঘটেছে যে কারণে আমরা আশা করছি এটি কম ক্ষতিকর হবে কারণ কোষের সঙ্গে এর (ভাইরাস) সংযুক্তি আগের মতো জোরাল নয়। কিন্তু চিকিৎসার ভাষায়, বড় ধরনের কোনো গবেষণার আগে এটা আমরা বলতে পারি না যে এটা শতভাগ সত্যি। তবে অবশ্যই কিছু জীনগত পরিবর্তন ঘটেছে’।
সূত্র: শাহনাজ পারভীন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা।