গোপাল অধিকারী :
মানুষের জীবন অর্থই রোগ-ব্যাধি সুস্থতা সবকিছু মিলে। তবে বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে কোন রোগই আর রোগ নয়। যেকোন রোগেরই স্বাস্থ্যবিধি বা ঔষধ খেলে মুক্তি মেলে। কিন্তু বিভিন্ন রোগে আমাদের অতিরঞ্জিত মনোভাব আমাদের ক্ষতির কারণ বলে আমার মনে হয়। একসময় ভাবতাম এগুলো মনে হয় শুধু গ্রামের নিরক্ষরদের মধ্যেই আছে কিন্তু না, এখন দেখি এই অতিরঞ্জিত বোঝার ব্যাপারটা অনেকের মধ্যেই আছে।
অতিরঞ্জিত বোঝার ব্যাপারটা ভালকে মন্দ করে বোঝা বাঙালীর অর্জন নয়, বরং বাঙালীকে কলঙ্কিতই করেছে। বিশ্বব্যাপী এক প্রকার যুদ্ধই চলছে বলা যায় যার এক প্রান্তে সকল দেশের জনগণ আর অপর প্রান্তে করোনা। যুদ্ধে তবু একটি স্বস্তির জায়গা থাকে কিন্তু করোনার কাছে কেউ যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। সকলের মধ্যে কাজ করছে মানসিক চাপ। বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। করোনা এখন অভিশপ্ত নামও বটে। করোনার ভয়াল থাবার শিকার বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ। আর করোনার প্রভাব পরেছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ সকল কিছুর উপর। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সারি। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও করোনার কাছে আজ পরাজিত। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে ৫ মে মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ১০৯২৯ জন আক্রান্ত হয়েছে।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৪৬৯ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৫১৫১০ জন। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পরে। তারপর থেকেই চলছে করোনার তান্ডব। করোনাকালে আমার দেখা সেরা সহযোগীতা পাচ্ছে দেশের মানুষ, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক। সরকার এই সংকটময় সময়ে যা দিয়েছে তা মাইলফলক। কিন্তু এই ইতিবাচক সময়ে জনমনে দেখা দিচ্ছে একটি বিষাদময় সংবাদ। বিভিন্ন এলাকায় করোনা না হলেও করোনারোগী বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সেই সাথে সেই পরিবারকে হেয় করা হচ্ছে, ঘৃণা করা হচ্ছে করোনায় আক্রান্তব্যক্তিকে। পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক খবরই দেখছি যে, করোনা রোগীকে খাবার দিচ্ছে না।
করোনা রোগীকে ঘর ভাড়া দিচ্ছে না। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো করোনা রোগে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সাথে কেউ যোগাযোগ করছে না। মনে হচ্ছে করোনা হওয়া অর্থই সে যেন সমাজের নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত হয়েছে। যার কারণে অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হলেও কাউকে বলছে না। মনে হচ্ছে এই রোগটা হওয়া অর্থই যেন নির্ঘাত মৃত্যু আর সমাজ থেকে বিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? আসলে কি এই রোগটি এমন? আমরা বাংলাতে ভাবসম্প্রসারণ পড়েছি, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।’ অর্থ্যাৎ একজন যদি চুরি করে তাহলে তার সেই চুরি বিদ্যাকে ঘৃণা করতে হবে। কারণ সেই চুরি করাটা মহাপাপ। কিন্তু আমরা যদি চোরকে ঘৃণা করি তাহলে সে কখনও ভাল পথে আসবে না। সে যদি ভাল পথে না আসে তাহলে কিন্তু সমাজে চুরির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাহলে বিষয়টা কি হলো?
তাকে কিন্তু ভাল হবার সুযোগ দেওয়া হলো না। সামাজিকভাবে সে যেন এই অপরাধে জড়িত না থাকে সেটা বলা যেতে পারে বা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তাকে অবহেলা করার মধ্যে কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। বরং চোরকে যদি কেউ কোন পরামর্শ দিয়ে ভাল পথে আনতে পারে সেটাই সফলতা। করোনার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই পরামর্শ। একজন করোনা আক্রান্ত রোগীতো মহাপাপীও না অপরাধীও না। এটা প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে। তাহলে তাকে তাচ্ছিল্য করার কোন কারণতো আমি দেখি না। হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকা অর্থ সে অপরাধী নয়। যে রোগের যে চিকিৎসা। করোনা রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা রাখা উচিত কারণ তার সাথে কারো সংস্পর্শ হলে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে বা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে।
রোগীর সুস্থতা ও পরিবারের সুস্বাস্থ্য চিন্তা করে এই প্রতিকার। তাহলে কেন করোনা হলেই সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ তাকে ভাবা হচ্ছে? আমার মনে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন প্রচার-প্রচারণা বা প্রবণতা রয়েছে বিশেষ করে গ্রামে এটি বেশি ভাবা হচ্ছে কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষেরই স্ব স্ব মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া এমন প্রবণতার কারণে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বা চাপ কাজ করছে। ফলে আগে থেকেই অসুস্থ রোগীরা এই মনোবৃত্তি করতে করতে মারা যাচ্ছে বা যেতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত্রকারী নয় বরং এই সংকটময় সময়ে যারা চাল চুরি বা জনগণের টাকা পকেটে রেখে পকেট ভারী করছে তাদের ঘৃণা করা উচিত। আমরা যদি চাল চোরকে ঘৃণা না করে সঙ্গ দিতে পারি, সমাজে ধর্ষণ করে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি তাহলে করোনারোগী কেন অপরাধী হবে? সে কি করোনা নিজে সৃষ্টি করেছে, সে কি ইচ্ছে করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে? প্রত্যেকেরই কিন্তু নিজ নিজ জীবনের মূল্য আছে। করোনা একটি রোগ এবং এই রোগ নির্মূল করা যাবে না তাও না। আপনারা অনেকেই দেখেছেন এই রোগ থেকে বিশ্বের অনেক দেশের অনেকেই সুস্থ হয়েছে।
সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনা নিয়েই জীবন। সুখও দীর্ঘস্থায়ী নয় আবার দুঃখও দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেই ধারাবাহিকতায় করোনও দীর্ঘস্থায়ী নয়। একসময় দেশে ক্যান্সার হলে, যক্ষা হলে রক্ষা ছিল না। এখন এই মরণব্যাধীরও ঔষধ বের হয়েছে। এখন আর যক্ষারোগীকে কেউ আলাদা মনে করে না। তাই করোনা আক্রান্ত রোগীও আলাদা নয়।
আমরা করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিবারের প্রতি সদয় হই , তাদের খোঁজ-খবর নেই। করোনা দূর করতে শক্তি ও সাহস দেই। পাশাপাশি করোনা যেন আমাদের মাঝে দুরত্বের সৃষ্টি না করে আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা সাময়িক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারি। তবে এই অজুহাতে আমরা যেন নির্দয় না হয়। বরং করোনার কারণে আমাদের মাঝে যাদের দূরত্ব আছে তাদের করোনা পরবর্তীকালে একত্রিত হতে হবে। কারণ এই করোনা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে রাগ-হিংসা-ঈর্ষা কোনটাই আমাদের নয়। এই মন্দ অভ্যাসগুলো আমাদের কোন ভাল কিছু করতে সাহায্য করে না।
কে্উ কি এমন সংবাদ পেয়েছেন কোন এলাকায় কোন মানুষের হিংসার কারণে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন? পাই নাই কিন্তু বরং কোন অসামাজিক মানুষ করোনায় মারা গেলে লোক মুখে প্রচার হবে লোকটি খুব অসামাজিক ছিল তাই সৃষ্টিকর্তা তাকে তুলে নিছেন। এই যে সমাজের মন্দ অভ্যাস আসুন আমরা করোনার সাথে দূর করি। সমাজের এই অসঙ্গতিগুলো দূর করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের। বিশেষ করে সমাজের গুণীজন বা দায়িত্বশীল সুনাগরিক রয়েছে আমাদের সকলের উচিত যারা করোনাকে নিয়ে এমন প্রবণতার পরিচয় দিচ্ছে তাদের বোঝানো। করোনা অর্থ কলঙ্কিত নয়। করোনা রোগ নিরাময়যোগ্য।
শুধু করোনা নিয়েই নয়, সমাজের সকল অসঙ্গতির বিষয়ে সঠিক পরামর্শ তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমার মনে হয় করোনা নিয়ে এই বিকৃত তথ্য আরও বাড়তে থাকবে। তবে এমন অসচেতনতামূলক কথা বাড়তে দেওয়া যাবে না। করোনারোগীর মনোবল হারানো যাবে না। করোনা থেকে শিক্ষা নেই, সকলে মিলে হাতে হাত রেখে পাপকে ঘৃণা করে, পাপীকে ভাল পথে সুস্থ জীবন গড়তে উৎসাহিত করি। তাহলেই সমাজে বিস্তৃতি পাবে না অপসংস্কৃতি বা অসঙ্গতি। সকলের মর্যাদা হবে সমান। সরকারের প্রতি অনুরোধ করোনা রোগীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন। সর্বশেষ একটি সত্য ঘটনা দিয়ে শেষ করব। আমার বাড়ির পাশের বাড়িতে ঢাকা থেকে একজন করোনারোগী আসছে এমন কথায় সকলে তত্পর। চারদিকে ঢাক-ঢোল করোনারোগী আসছে ।
পাড়ার যুবকরা তার পরিবারকে ডেকে ঘরবন্দী জীবন-যাপনের নির্দেশ। কথার বিকৃতি ঘটে পরে শোনা গেল আমার বাড়িতে করোনারোগী। আমার বাড়ি লকডাউন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল ঢাকা ফেরত বাড়ি থেকে ওই পরিবারের সন্তানকে নিজ বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য নিয়ে আসে। অথচ কোন নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই তার পরিবারকে ঘরবন্দী করে রাখা বা করোনারোগী বানানো এটা কি অপরাধ নয়? এই যে গুজব বা আইন লংঘন বা ঘৃণা এগুলো কারোই কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে নমুনা সংগ্রহ করলেও সে করোনা আক্রান্তকারী নাও হতে পারে । কারণ পরীক্ষা করা হয়েছে অনেকের সকলেই কিন্তু রোগী নয়। আমাদের জেনে, বুঝে, দেখে কথা বলতে হবে। রোগী তারাই যাদের প্রশাসন থেকে চিহ্নিত করা হবে। আমি আবারও বলছি করোনারোগ নিরাময়যোগ্য। আসুন আমরা সকলে মিলে করোনারোগীর খোঁজ-খবর নিয়ে করোনার কলঙ্ক মুক্ত করি। প্রিয় মানুষগুলোকে বাঁচতে অনুপ্রেরণা দেই। সচেতনতাই এর মূল অস্ত্র। করোনা অর্থ ঘৃণা নয়। করোনা অর্থ সচেতনতা হোক। আসুন আমরা আরও মানবিক হই।
লেখকঃ সাংবাদিক