দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ভোজনখালী গ্রামের ঢাংমারী-ভোজনখালী সার্বজনীন হরিসভা অঙ্গন পরিদর্শন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি (খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা), ভারত বিচিত্রার সম্পাদক এবং খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য শ্রী নান্টু রায়। ১ মার্চ তার এই পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন বাজুয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদেশ রায় কেনেডি, রামনগর বীণাপাণি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পবিত্র মৃধা, মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মন্টু কুমার মন্ডল, স্থানীয় ইউপি সদস্য জয় কুমার মন্ডল, সংরক্ষিত ইউপি সদস্য পাপিয়া মিস্ত্রী, প্রাক্তন ইউপি সদস্য হিরন্ময় রায়, সমাজসেবক সনজ রায়, বাজুয়া সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক গৌতম রায়, শিক্ষক সমীর রায় প্রমুখ।
এ সময় মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজিত ধর্ম আলোচনায় শ্রী নান্টু রায় বলেন, ঈশ্বরের আরাধনার জন্য আমাদের অতিরিক্ত আড়ম্বরের কোনো প্রয়োজন নেই, কোনো মাধ্যম ধরারও প্রয়োজন নেই। মূল বিষয় হলো আমাদের উপলব্ধি, যে উপলব্ধি আমাদের মনোজগতে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে লাভের বসনাকে বেগবান করবে। ঈশ্বরের সান্নিধ্য চাইলে ধর্মশাস্ত্রে পিএইচডি করারও প্রয়োজন নেই, ঈশ্বরের সান্নিধ্য চাইলে যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে যে কোন অবস্থায় ঈশ্বরকে চাইতে পারে। কারণ ঈশ্বর সর্বজান্তা, সর্বব্যাপী, সর্ব কর্তৃত্ব সম্পন্ন- তিনি সব জানেন, সব বোঝেন- এই কথা যদি আমরা বিশ্বাস করি তাহলে তার সান্নিধ্য লাভের জন্য আমাদের কোনো মাধ্যম বা মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন পড়ে না।
আলোচনায় তিনি বলেন, কতিপয় পৌরানিক গ্রন্থে হিন্দু দেবদেবী সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ উপস্থাপনাকে লালন করতে আমরা বেশি আগ্রহী, আমরা কৃষ্ণ চরিত্রের মহিমান্বিত মাহাত্ম্যকে আড়াল করে রাধা নামক কল্পিত কহিনিতে বিগলিত হতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। খ্রিস্টীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণের সাথে রাধার মুখরোচক কাহিনী যুক্ত করে কৃষ্ণের চরিত্রকে কলঙ্কিত করা হয়েছে, কৃষ্ণবিদ্বেষীরা কৃষ্ণচরিত্রে কলঙ্ক আরোপের জন্য ব্রজগোপীতত্ত্ব ফেনায়িত করেছেন, কিন্তু মহাভারতে ব্রজগোপীদের কথা কিছুই নেই। শ্রীমৎভগবত গীতায়, কিংবা ব্যাসদেব রচিত কৃষ্ণের জীবন কাহিনি হরিবংশ- কোথাও রাধা নামক কোনো চরিত্র নেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কদর্য ভাষায় রাধাকৃষ্ণের যে লীলার কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ যে ঈশ্বর, তার প্রতি যে শ্রদ্ধার ভাব সেটি তিরোহিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবী সম্পর্কেও সেখানে নানান মুখরোচক গল্প কাহিনী যুক্ত করে সেই সকল দেব-দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি জাগানোর পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে। উক্ত দেবদেবীকে সেখানে কামনা বাসনার প্রতিভূ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যার ফলে সেটাকে একটা ভক্তিশাস্ত্র বলে আমাদের মনে হয় না, তার পরিবর্তে জাগতিক কামনা বাসনা আমাদের ঘিরে ধরে। একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নিজ মতাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে এই সকল দেবদেবীকে বিভিন্ন কল্পকাহিনীর মধ্য দিয়ে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছিল, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তেমনি একটি প্রয়াস।
তিনি বলেন, অথর্ববেদের উপনিষদসমূহের মধ্যে গোপালতাপনী নামে অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদে কৃষ্ণকে গোপগোপীপরিবৃত দেখা যায়। কিন্তু এতে গোপগোপীর অর্থ প্রচলিত অর্থের থেকে আলাদা। এখানে গোপী অর্থে অবিদ্যা কলা। আর গোপীজনবল্লভ অর্থে ‘গোপীনাং পালনশক্তীনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।’ উপনিষদে গোপীর এমন অর্থ আছে, অথচ রাসলীলার কোনো কথাই নেই। রাধার নামমাত্র নেই। একজন প্রধানা গোপীর কথা আছে, তিনি রাধা নন, তাঁর নাম গান্ধর্বী। তাঁর প্রাধান্যও কামকেলিতে নয়, তত্ত্বজিজ্ঞাসায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর জয়দেবের কাব্য ছাড়া কোনো প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নেই। অথচ এখন কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ছাড়া এখন কৃষ্ণনাম নেই। রাধা ছাড়া বাংলায় কৃষ্ণের মন্দির নেই, মূর্তি নেই। বৈষ্ণবদের অনেক রচনায় কৃষ্ণের চেয়েও রাধা প্রাধান্য লাভ করেছেন। যে রাধাকে নিয়ে ভারতবর্ষ বিশেষত বাঙলা মাতোয়ারা, সেই রাধার উল্লেখ মহাভারতে নেই—বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, এমনকি ভাগবতেও নেই।
তিনি বলেন, আমাদের ধর্মশাস্ত্রে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, তা হলো ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’। বলা হয়েছে ইহজগত মিথ্যা, তোমার উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ। অসংখ্য তীর্যক যোনি পেরিয়ে এই মানবজীবন লাভ করেছ, যদি আবার খারাপ কাজ কর তাহলে আবারো তির্যক যোনি প্রাপ্ত হতে হবে- তোমার মোক্ষলাভ আর হবে না। জন্মান্তরবাদের এই মতবাদ আমাদেরকে পঙ্গু করেছে, আমাদেরকে পৃথিবী বিমুখ করেছে। ফলশ্রæতিতে আমরা ইহজাগতিক অস্তিত্বরক্ষার কৌশল অর্জন করতে পারছি না। নিজেরা নিজেদেকে আর রক্ষা করতে পারছি না।
আলোচনায় বাজুয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদেশ রায় কেনেডি বলেন, আমাদের এমন ধর্মমত চাই যে মতবাদ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে কোন বাধাই আর বাধা থাকে না। হিন্দু ধর্মের বিভক্তি অন্যতম কারণ হচ্ছে জাতিভেদ প্রথা, দ্বিতীয়ত গুরুবাদ। গুরুবাদের কারণে আমরা বিভিন্ন গুরুর অধীনে বহুধা বিভক্ত হয়েছি। এক গুরুর মন্দিরের বাইরে অন্য মন্দিরে আমরা যেতে পারি না, এইভাবে আমরা বিভক্ত হয়ে পড়েছি। একই ছাতার নিচে যতদিন আমরা না আসতে পারবো ততদিন আমাদের এই সনাতন ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারবো না।