না ফেরার দেশে চলে গেলেন খুলনা বিএল কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুহম্মদ কায়কোবাদ। বার্ধক্যজনিত কারণে ২৮ জুন ২০২০ রোববার সকালে তিনি নগরীর গগনবাবু রোডের বাসায় প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। খুলনার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রগতিশীল আন্দোলন এবং সংস্কৃতির বিকাশে সবিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মুহম্মদ কায়কোবাদ ১৯৯৩ সালে খুলনা বিএল কলেজ থেকে শিক্ষকতা পেশায় অবসর গ্রহণ করেন। মাঝে ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাগেরহাটের পিসি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার স্ত্রী মুক্তি মজুমদার একই কলেজের দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি মারা যান। নিঃসন্তান এই শিক্ষক দম্পতি খুলনার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন। তার অসংখ্য ছাত্র বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত রয়েছেন।
মুহম্মদ কায়কোবাদের মৃত্যুতে শিক্ষক সমাজে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোকের ছায়া নেমেছে তার সুহৃদ-স্বজন-গুণগ্রাহীদের মাঝে। তাঁর মৃত্যুতে আবেগঘন স্টাটাস দিয়েছেন দেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন:
খুলনার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ-এর বাতিঘর ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ কায়কোবাদ ও অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার দম্পতি। মফস্বল শহরের এই দুই অধ্যাপকের সাথে তাঁদের ছাত্রছাত্রী ও সকল স্তরের সহকর্মীবৃন্দের যে নিবিড় প্রাণের সম্পর্ক আমি আজীবন দেখেছি তার কোন তুলনা সত্যিই খুঁজে পাইনা। নিত্য যোগাযোগ আর আসা-যাওয়ায় মুখর হয়ে থাকতো খুলনার ফুলতলায় তাদের ধাম “আরণ্যক”। এমনকি ৪০ বা ৫০ কিংবা ৬০ বছর আগে ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন অথবা সদ্য কলেজে ঢুকেছেন অথবা কোনো পর্যায়ে সহকর্মী ছিলেন এমন শত শত মানুষকে আমি দেখেছি তাঁদের ঐ ছায়া সুনিবিড় শান্তিনিকেতনে। অনেকেই এসেছেন সন্তান নিয়ে তার শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। নিজ বাড়ির প্রশস্থ উঠোনে বা খোলা ছাদে অথবা ভেতরে বিশেষভাবে তৈরি হল রুমে পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, কিংবা স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস অথবা বর্ষা বা বসন্ত উৎসব উদযাপন গোটা এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকেই পাল্টে দিয়েছিল। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তো চারপাশ থেকে আসা বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে ৪০০-৪৫০ অংশগ্রহণকারীর সমাগম হতো প্রতি বছর! “আরণ্যক” থেকে বের হতো শোভাযাত্রা। খালিমুখে ঐ বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিল বারণ। বাড়িভরা পাঠাগার আর সকাল-সন্ধ্যা একক বা কলকণ্ঠে রবীন্দ্র- নজরুল- অতুল প্রসাদ-ডি এল রায়-রজনীকান্ত বা লালনের গান — অন্য এক জগৎ গড়ে তুলেছিলেন অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার আর অধ্যাপক মুহাম্মদ কায়কোবাদ। কে আসেননি এই তীর্থে! বিশ্বভারতীর শান্তিদেব ঘোষ ও কনিকা বন্দোপাধ্যায় এসেছেন, চিন্তাবিদ শিবনারায়ণ রায় এসেছেন, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবতঃ এসেছেন, আর হাসান আজিজুল হক তো ঘরেরই মানুষ। ছোটবেলা থেকে ঐ বাড়ির প্রতি (তখনও ওঁরা ফুলতলায় আসেননি, ছিলেন খুলনার খালিসপুরে, তারও আগে দৌলৎপুরে) আমার বিশেষ আকর্ষণের কারণ ছিল বইয়ের পাশাপাশি সাময়িকপত্রের অসাধারণ সংগ্রহ — দেশের আর, বিশেষতঃ, পশ্চিম বাংলার — পরিচয়, অনুষ্টুপ, কালান্তর, বর্তীকা, জিজ্ঞাসা, প্রমা, অনীক ইত্যাদি আরো অনেকের সাথে আমার পরিচয় ঐ গৃহে। প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর সূষম সমাজের প্রথম পাঠ আমি পেয়েছি ঐ গৃহে। নিজ পরিবারের বাইরেও যে একটি বড় পরিবার আছে এবং তারাও যে সমান আপন, এই বোধ আমাকে দিয়েছেন আমার মেজচাচা মুহাম্মদ কায়কোবাদ আর মেজচাচী মুক্তি মজুমদার। মেজচাচী আগেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে, আর মেজচাচা কাল চলে গেলেন না ফেরার দেশে।