মিজানুরের ভয়ে একাধিকবার বাসা পাল্টেছিলেন নারায়ণ রায়ের পরিবার। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই শহরে আর নয়, মেয়ের জীবন রক্ষার্থে ফিরে যাবেন গ্রামে। সেই মেয়ে অবশেষে বাবার সঙ্গে গ্রামেই ফিরলো। তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে।
গত রোববার রাতে সাভারে বখাটে মিজানুরের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হয় নীলা রায় নামের ওই ছাত্রী। সে স্থানীয় এসেড স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
এদিকে দুদিনেও আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে পরিবারটি।
জানা গেছে, রোববার রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বড় ভাই অলক রায়কে সঙ্গে করে রিকশায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয় নীলা রায়। পথিমধ্যেই ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় বখাটে মিজানুর রহমান। বড় ভাইয়ের সামনেই টানা-হেঁচড়া করে ছিনিয়ে নেয় নীলাকে। পরে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় দক্ষিণপাড়ায় নিজেদের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে। সেখানেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে পালিয়ে যায় ওই বখাটে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় নীলাকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
বখাটে মিজানুর রহমান স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানের ছেলে। সে স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী।
সোমবার যখন নীলার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয় তখন তার বাড়িতে চলছিল আহাজারি। পড়ার টেবিলে গুছিয়ে থাকা বই। ঘরজুড়ে স্মৃতি। টেবিলের বই নেড়েচেড়েই আদরের একমাত্র মেয়ের স্মৃতি হাতড়ে ফিরছিলেন মুক্তারানী।
মেয়ের বই জড়িয়ে বিলাপ করতে করতে মুক্তারানী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই মিজান আমার মেয়ের পিছু নিয়েছিল। আমি বুঝিয়েছি, বাবা তুমি বড়লোকের ছেলে। আমরা গরীব। ভাড়া থাকি। তার ওপর আমরা হিন্দু। কিছুতেই কিছু শোনেনি। একপর্যায়ে আমরা মিজানের বাবা-মাকে জানিয়েছি। বলেছি, আপনারা ছেলেকে সামলান। হুমকি দিয়ে বলতো, থানায় জানালে, আমার স্বামী ও ছেলের লাশ ফেলবে। ভয়ে মুখ বুজে থাকতাম। আমাদের কষ্টে কেউ এগিয়ে আসেনি- আমার মেয়েটাকে মেরেই ছাড়লো।’
নীলার বাবা নারায়ণ রায় মেট্রোরেল প্রকল্পের সামান্য বেতনের কর্মচারী। শেষ কৃত্যের জন্যে মেয়েকে নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশে যখন তিনি রওনা হন তখন তার দু’চোখ ঝাঁপসা। অব্যক্ত কষ্ট আর যন্ত্রণায় যেন ভেঙ্গে আসছে তার পৃথিবী। ডুকরে কেঁদে উঠে তিনি বলেন, ‘আমি তো মেয়ের জন্যই গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফিরলাম ঠিকই। তবে মেয়ের লাশ নিয়ে। আমার বেঁচে থাকার আর শক্তি নাই।’