বাঙালি জাতির প্রাণের স্পন্দন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি :
“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”
১৫ই আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে একদল নর পিশাচ, পাপিষ্ঠ ঘাতক সপরিবারে হত্যা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুরু হয় ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে সেই শোকের আগুন। একদিন যে অঙ্গুলি উঁচিয়ে যিনি বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর অঙ্গুলি চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয় কিছু মানুষ নামের হায়েনার দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক তার নিজ বাসভবনে। আর কোনদিন ঐ অঙ্গুলি আমাদের প্রেরণা দিতে আসবে না, দিবেনা কোন মুক্তির বারতা। কিন্তু তারা জানেনা বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড থাকবে, যতদিন সূর্য কিরন দেবে,পাখি গান গাইবে, নদী থাকবে বহমান – ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন বাঙালির অস্থিমজ্জায় মিশে, বাঙালির হৃদয়ের অনুপ্রেরণা হয়ে ।
ভয়ংকর সেই রাত:
ঘটনার সেই রাতে যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন মো. সেলিম (আব্দুল) ও আব্দুর রহমান শেখ (রমা)। উপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, “সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।” পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্রই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠে গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে প্রধান ফটকের বাইরে এসে দেখেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি …”। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরায় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন।
গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।” এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান।
ঠিক তখনই মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস্ আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান। কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।” মহিতুল ঘাতকদের বলেন, “উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি মহিতুলের হাঁটুতে আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে। এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ দেয়।
বঙ্গবন্ধু দোতলায় তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।” তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।” জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউজ?” বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি- বেয়াদবি করছিস কেন?” এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকে। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে।
লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?” মহিতুল জবাব দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।” এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে। আজিজ পাশার কথা মতো এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়। আর মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়। রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।মানুষরূপী হায়েনার হাত থেকেও সেদিন রেহায় পায়নি ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল।
রক্তপিপাসু হিংস্র নরপশুর দল সেদিন একে একে বঙ্গবন্ধু স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুত্র শেখ কামাল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, পুত্র শেখ জামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দু’মেয়ে ছিলেন না। বড় মেয়ে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মানবতার মা শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সেদিন ছিলেন বেলজিয়ামে। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন জার্মানি ছিলেন।
১৫ই আগস্টের পরের দিন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর লাশ ছাড়া নিহতদের লাশ দাফন করেন। বনানী কবরস্থানে সারিবদ্ধ কবরের মধ্যে প্রথমটি বেগম মুজিবের, দ্বিতীয়টি শেখ নাসেরের, এরপর শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, শেখ রাসেল, ১৩ নম্বরটি শেখ মণির, ১৪ নম্বরটি আরজু মণির, ১৭ নম্বরটি সেরনিয়াবাতের আর বাকি কবরগুলো সেদিন এই তিন বাড়িতে যারা মারা গেয়েছিলেন তাদের। ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে তার বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বাংলার মহামানব, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আজ শুধু সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে নয়, বাংলার আকাশ- বাতাস প্রকৃতিরও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের রক্তে আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে একাকার হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতি রক্তের অশ্রুপাত করেছিল। আজ শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গের ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : শিক্ষক, ত্রিমোহনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দাকোপ, খুলনা।